নামাজে দাঁড়ানোর সঠিক পদ্ধতি
নামাজ হলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। সালাতের সময় হলে, আমরা পাক-পবিত্র হয়ে এবং পাকসাফ কাপড় পরিধান করে পবিত্র জায়গায় কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াব। নামাজের পূর্বে মনে রাখতে হবে, আমরা আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তিনি আমাদের সবকিছু দেখছেন এবং অন্তরের খবর জানেন। তাই সঠিকভাবে নামাজ আদায় করার জন্য কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি।
১. তাকবিরে তাহরিমা:
নিয়ত করে আল্লাহু আকবর বলার মাধ্যমে নামাজ শুরু হবে। এটি তাকবিরে তাহরিমা নামে পরিচিত।
- ছেলেরা: দুই হাত কান বরাবর তুলে নেবে। এরপর দুই হাত নাভির ওপর রেখে বাঁধবে (কারো কারো মতে বুক থেকে নাভীর উপর পর্যন্ত যেকোনো যায়গায় বাঁধা যাবে)।
- মেয়েরা: দুই হাত কাঁধের সমান পর্যন্ত উঠাবে এবং পরে বুকের ওপর হাত বাঁধবে।
২. হাত বাঁধার সঠিক পদ্ধতি
- ছেলেরা: বাম হাতের তালু নাভির ওপর রাখবে এবং ডান হাতের তালু বাম হাতের পিঠের ওপর রেখে কনিষ্ঠ ও বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা বাম হাতের কবজি ধরবে। মাঝের তিনটি আঙুল বাম হাতের কবজির উপরে বিছিয়ে রাখবে।
- মেয়েরা: শুধু বাম হাতের উপরে ডান হাত রাখবে। এরপর সানা পাঠ করতে হবে।
বাংলা উচ্চারণ: সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারাকাসমুকা, ওয়া তাআলা জাদুকা, ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।
অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি এবং তোমার জন্য সকল প্রশংসা। তোমার নাম বরকত ও কল্যাণময়। তোমার সম্মান অতি উচ্চে। তুমি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই।”
৩. রুকুর সঠিক পদ্ধতি
এবার আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম এবং বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়ে সূরা ফাতিহা ও অন্য কোনো সূরা পাঠ করার পর আল্লাহু আকবর বলে রুকুতে যাওয়া হবে।
- ছেলেরা: দুই হাত দুই হাঁটুর উপর রাখতে হবে, যাতে মাথা, পিঠ এবং কোমর এক সোজা লাইন হয়। কনুই পাজর থেকে ফাক করে রাখতে হবে।
- মেয়েরা: বাম পায়ের টাখনু ডান পায়ের টাখনুর সাথে মিলিয়ে রাখবে। মাথা এতটুকু ঝুঁকাবে, যাতে হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছায়।
রুকুর সময় অন্তত তিনবার ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম’ পাঠ করতে হবে।
৪. সিজদাহ করার সঠিক পদ্ধতি
রুকু শেষ করে আল্লাহু আকবর বলার পর সিজদাহ করতে হবে।
- ছেলেরা: দুই হাঁটু মাটিতে রাখবে এবং দুই হাত মাটিতে রেখে আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে কিবলামুখী করবে। মাথা, নাক এবং কপাল মাটিতে রাখবে। পা খাড়া থাকবে, কিন্তু উরু ও পায়ের নলা পৃথক থাকবে।
- মেয়েরা: পা খাড়া রাখবে না, উভয় পা ডান দিকে বের করে মাটিতে বিছিয়ে রাখবে। সিজদাহ করতে গিয়ে মাথা হাঁটু কাছে রাখবে এবং হাত, পা, উরু একত্রিত করবে।
সিজদাহয় অন্তত তিনবার ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ বলতে হবে।
৫. তাশাহহুদ পড়ার সঠিক পদ্ধতি
সিজদাহ শেষে সোজা হয়ে বসে তাশাহহুদ পড়তে হবে।
- পুরুষ ও নারী: সিজদাহ শেষ করার পর, সোজা হয়ে বসতে হবে। দুই হাত হাঁটুর উপর রাখবে তাশাহহুদ পড়বে: “আত তাহিয়াতু লিল্লাহি ওয়াস সালাওয়াতু ওয়াস তাইবাতু, আস সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আস সালামু আলাইকা আইয়ুহা নবী, ওয়াহলি সালাহু আলাইকা, ওয়াহলাল কিরাম উলাল আলামিন।”
৬. সালাম ফেরানোর সঠিক পদ্ধতি
প্রথম রাকআত শেষ হওয়ার পর তাশাহহুদ, দরুদ এবং দোয়া মাসুরা পড়ার পর ডানে এবং বামে মুখ ফিরিয়ে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলবে।
এভাবে দুটি রাকআত বিশিষ্ট সালাত শেষ হবে। তবে, তিন বা চার রাকআত বিশিষ্ট সালাত হলে তাশাহহুদ পর্যন্ত পড়ার পর “আল্লাহু আকবর” বলে দাঁড়িয়ে বাকি রাকআত শেষ করতে হবে।
এটি সুন্নত ও নফল সালাতের জন্য, কিন্তু ফরজ সালাতে পরের দুই রাকআতে সূরা ফাতিহার সাথে অন্য সূরা যোগ করা যাবে না।
সালাত শেষে তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া মাসুরা পড়ে, প্রথমে ডানে এবং পরে বামে মুখ ফিরিয়ে সালামের মাধ্যমে নামাজ শেষ হবে।
উল্লেখ্য: নারীদের নামাজে কিছু পার্থক্য রয়েছে, যেমন সিজদাহতে পা বের করে রাখা, কনুই পাজর থেকে সোজা রাখার পদ্ধতি, এবং নামাজের সময় শরীরের অবস্থান। তবে পুরুষ এবং নারীর নামাজ আদায়ের মৌলিক পদ্ধতি প্রায় একরকমই।
এই পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করে পুরুষ এবং নারীরা সঠিকভাবে নামাজ আদায় করতে পারবেন, যাতে তাদের ইবাদত আল্লাহর নিকট পূর্ণাঙ্গ ও গ্রহণযোগ্য হয়।
নারী-পুরুষের নামাযের পদ্ধতি একই হওয়ার বেপারে নিম্নে কিছু দলীল পেশ করা হলো:-
পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতি মূলত এক। মহিলাও পুরুষের মতো নামায পড়বে, কারণ রসূল (ﷺ) উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন, “তোমরা সেইভাবে নামায পড়ো, যেরূপ আমাকে পড়তে দেখেছো।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৬৮৩নং)। অতএব, পুরুষ ও মহিলার নামাযের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই।
যে আদেশ শরীয়ত পুরুষদের জন্য নির্ধারণ করেছে, তা মহিলাদের জন্যও প্রযোজ্য, এবং যে সাধারণ আদেশ মহিলাদের জন্য রয়েছে, তা পুরুষদের জন্যও পালনীয়, যদি না কোনো বিশেষ দলীল থাকে। উদাহরণস্বরূপ, কুরআনে বলা হয়েছে, “যারা সতী মহিলাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করবে, এবং চারজন সাক্ষী না দিতে পারবে, তাদের জন্য শাস্তি ৮০ কোড়া।” (কুরআন ২৪:৪)। যদি কেউ সৎ পুরুষের বিরুদ্ধে একই অপবাদ দেয়, তবে তার জন্যও ওই শাস্তি প্রযোজ্য।
অতএব, মহিলাদের নামাযে পুরুষদের মতোই হাত তোলা, পিঠ সোজা করে রুকূ করা, সিজদায় পেট ও পায়ের রোলাক থেকে দূরে রেখে পিঠ সোজা রাখা এবং তাশাহহুদে পুরুষদের মতো বসা উচিত। উম্মে দারদা (রাঃ) তাঁর নামাযে পুরুষের মতো বসতেন, এবং তিনি ছিলেন একজন ফকীহ। (আত-তারীখুস স্বাগীর, বুখারী ৯৫ পৃঃ, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩৫৫)। মহিলাদের সিজদা সঠিকভাবে না করার কোনো সহীহ হাদীস নেই। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ২৬৫২ নং)। এ বিষয়ে ইবরাহীম নাখয়ী (রহঃ) বলেন, “নামাযে মহিলাকে পুরুষের মতোই করতে হবে।” (ইবনে আবী শাইবা, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ১৮৯ পৃঃ)।
তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে মহিলাদের নামায পুরুষদের থেকে ভিন্ন হতে পারে। যেমন:
১. বেগানা পুরুষের উপস্থিতিতে মহিলারা জেহরী নামাযে সশব্দে কুরআন পড়বেন না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩০৪)। এছাড়া, মহিলারা পূর্ণ পর্দায় নামায পড়বেন।
২. মহিলা ইমামতি করলে, তিনি পুরুষদের মতো সামনে না দাঁড়িয়ে কাতারের মাঝে দাঁড়াবেন।
৩. ইমামের ভুল ধরানোর জন্য মহিলারা ‘সুবহা-নাল্লাহ্’ বলবেন না, বরং হাততালি দিয়ে ভুল সংশোধন করবেন।
৪. মহিলাদের চুল বাঁধে নামায পড়া বৈধ, কিন্তু পুরুষদের জন্য এটি বৈধ নয়, বিশেষত যদি চুল লম্বা হয়।
এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও দলীলগুলো যথাস্থানে পাওয়া যাবে।
আরও একটি ভুল ধারণা হলো, অনেক মহিলা মনে করেন যে মসজিদে বা বাড়িতে পুরুষদের নামায না হলে তারা নামায পড়বেন না। এটি সম্পূর্ণ ভুল। আযান হলে বা নামাযের সময় হলে মহিলাদেরও অবশ্যই প্রথম সময়ে নামায পড়া কর্তব্য। (মুত্বাসা ১৮৮-১৮৯ পৃঃ)।